মাটির ময়না - বাংলা ও বাঙালির আত্মকথা
চিত্রপরিচালক তারেক মাসুদ পরিচালিত ‘মাটির ময়না’ তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি। এটি কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত প্রথম বাংলাদেশী ছবি। এটি ২০০২ সালে ডিরেক্টরস ফোর্টনাইট নামক অধ্যায়ে প্রদর্শিত হয়। সিনেমাটি ভূষিত হয় FIPRESCI পুরস্কারে।

শহর কলকাতা এবং পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান যে পরিস্থিতি, তাঁর মধ্যে ধীরে ধীরে অনুভব করা যায় যে বাংলা ভাষার প্রতি বাঙালির আবেগ বেড়ে চলেছে এবং তাঁর প্রভাব কেবল আমাদের ব্যাক্তিগত জীবনে না, বঙ্গরাজনীতিতেও প্রতিফলিত হচ্ছে। বাংলার মানুষের যে বাঙালি পরিচয়, তাঁর ভিত্তিতে আস্তে কিন্তু অবিচলে এক বঙ্গপ্রেম জন্ম নিচ্ছে।

এই বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে একাংশের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও কৌতূহলের জন্যই আজ বাংলা ভাষার এক নবজাগরণ ঘটছে। এই নবজাগরণের মূলে রয়েছে কলকাতার হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা, রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা নিয়ে চর্চা, চলছে সত্যজিৎ রায়ের লেখা ও চলচ্চিত্র নিয়ে মাতামাতি, চলছে সমগ্র কলকাতা নিয়ে এক নাওয়া-খাওয়া ভুলিয়ে দেওয়া বৌদ্ধিক অভিযান। অবশ্য এসবের মাঝে আমরা একটি মূল বিষয় ভূলে যাচ্ছি, যে শহর কলকাতার বাইরেও বাংলার অবস্থান আছে, যা প্রধানত একটি গ্রামীণ সভ্যতা।
“মাটির ময়না” ছবিটি দেখে সত্যি বোঝা যায় বাংলার প্রতি তারেক মাসুদের ভালোবাসা। তিনি বাংলাদেশকে ভালোবেসেছেন তাঁর অপরিশীলিত ও অপরিশোধিত রূপের মধ্যে দিয়ে, গ্রামিণ বাংলার মধ্যে দিয়ে। তাঁর এই ভালোবাসা শহুরে অভিজাত বাঙালি মধ্যবিত্তের জন্য একটি বাস্তবতা পরিক্ষা রূপে ফুটে ওঠে যা সবাইকে মনে করিয়ে দেয় যে শহুরে সভ্যতার বাইরেও বাংলা আছে এবং সবাই যেন শ্রেণি বিভাজনকে সম্পূর্ণভাবে ভুলিয়ে দিয়ে নিজের ভাষা, নিজের মাটি ও সেই মাটির মানুষকে ভালোবাসতে যার থেকে বহু মানুষের আত্মপলব্ধি ঘটতে পারে।

চলচ্চিত্রটির কাহিনী অনুপ্রাণিত পরিচালকের নিজের বাল্যকালের কিছু ঘটনা থেকে, তাই এটিকে একটি আত্মজীবনীমূলক চলচ্চিত্র বলা যায়। চলচ্চিত্রটি তুলে ধরছে ‘৬০ এর দশকের, গ্ৰাম্য বাংলাদেশের একটি কিশোর ছেলে আনু, তার দৈনন্দিন জীবন ও বয়স প্রাপ্তির গল্প। অবশ্য পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার তারেক মাসুদ আনুর বয়স প্রাপ্তি ঘটাচ্ছে তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে, যে কারণে এই চলচ্চিত্রটি কেবল আনু নয়, সমগ্র বাংলাদেশ ও তাঁর মানুষের আত্মজীবনী হিসেবে উঠে আসে।

চলচ্চিত্রটি শুরু হয় একটি মাদ্রাসার ভোরবেলার দৃশ্য দিয়ে, যেখানে একজন মাঝ বয়সী ভদ্রলোক একটি বছর দশকের ছেলেকে একটি নিমের দাতন ধরিয়ে তা ব্যবহার করা সেখাচ্ছেন। এই সম্পূর্ণ দৃশ্যটি ঘটছে একটি নদীর ঘাটে।
কিছুক্ষণ পরেই আমরা জানতে পারি যে ছেলেটির নাম আনু। তার বাড়ি পূর্ব পাকিস্তানের একটি গ্রামে। আনুর বাবা কাজী হচ্ছেন একজন ধর্মান্ধ ব্যক্তি। তিনি সবরকম ‘সাহেবিয়ানা’ একেবারে ঘৃণা ও অবজ্ঞা করেন। তিনি একজন হোমিওপ্যাথ এবং সাহেবদের অ্যালোপ্যাথিকে অবিশ্বাস করেন। তাঁর ভাই এবং আনুর কাকা, মিলন, একেবারে বিপরীত। বামপন্থী আদর্শে বিশ্বাসী মিলন কাজীর ধর্মান্ধতার তীব্র বিরোধী, কিন্তু স্বজোরে ব্যক্ত করে না। কাজী কোন রকমেই চায়না আনু কোন ভিন্ন ধর্ম আচার অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হোক কারণ সে নিজে তাকে, নিজের মতো, আদর্শ মুসলমান বানাতে চায়। এমন কি কাজী আনুকে মাদ্রাসাতে পাঠিয়ে দিয়েছিল কারণ সে মিলনের সঙ্গে একটি হিন্দু অনুষ্ঠান দেখতে গিয়েছিল। যখন মিলন তাকে পুজোর বাতাসা দিতে যায়, কাজী সেগুলিকেও বিদেশি বলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।

আনুর মা, আয়েশার মধ্যে থেকে যেন এক প্রচণ্ড শান্ত অথচ চাপা পরাধীনতার দুঃখ বিকশিত হচ্ছে। আয়েশাকে কাজী তাঁর বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি করে রেখেছে এবং তাঁর যে স্বাধীন হওয়ার ইচ্ছে আছে, তা আনুর বোন, আসমার মধ্যে দিয়ে বিকশিত হয়। পরবর্তীতে দেখা যায় আসমার বেশ কয়েক দিন ধরে শরীর খারাপ। কাজী আয়েশাকে বলেছিল যেহেতু আসমা বাইরে খেলতে যাচ্ছে, সেই জন্যেই তার জ্বর হচ্ছে। তবুও আয়েশা আসমাকে বাইরে খেলতে যেতে দেয় কারণ সে তার স্বাধীনতা হরণ করতে চান না।

যখন আনু মাদ্রাসাতে ভর্তি হয়, প্রথমেই তাকে কদম ছাট দিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে তার নতুন নামকরণ হয়, মুহম্মদ আনয়ারুল ইসলাম। মাদ্রাসাতে মূলত দু’জন ধার্মিক গুরুকে দেখানো হয়েছে। বড় হুজুর, যিনি প্রচন্ড কর্কশ, ছাত্ররা তাকে ভীষণ ভয় পায় এবং তিনি মারাত্মক পরিমানে ধর্মান্ধ। দ্বিতীয়জন, ইব্রাহিম হুজুর হলেন নরম ও সংবেদনশীল ব্যক্তি, তাকে ছাত্ররা খুব ভালোবাসে। আবার বড় হুজুরের বিপরীতে, তিনি একেবারেই ধর্মান্ধ নন, যা আমরা ক্রমশ বুঝতে পারি।



মাদ্রাসাতে আনুর বন্ধুত্ব হয় রোকন নামক এক আত্মভোলা ও কল্পনাপ্রবণ ছেলের সাথে। রোকন মাদ্রাসার অন্য পাঁচটা ছেলের থেকে অনেকটা আলাদা, যে কারণে তাকে সবাই পাগল বলে ক্ষেপায় ও তাকে বিব্রত। মাদ্রাসাতে একটি মধ্যাহ্নভোজনের দৃশ্যে আমরা জানতে পারি যে রোকনের মাছ দেখলে ভীষণ বমি পায়। সেদিন রাতেই দেখা যায় যে রোকনের বিছানাতে মাছ রাখা আছে, যা মাদ্রাসার ছেলেরা রেখেছিল। তার অস্বস্তি দেখে মজা পাওয়ার জন্য। এরপর আনুর জীবনের এবং তৎকালীন পূর্ববঙ্গের যে সমস্ত ঘটনার কারণে এই চলচ্চিত্রটি জীবন্ত হয়ে উঠছে, তা বুঝতে গেলে একজনকে এটি দেখতে হবে।

চলচ্চিত্রটিকে বুঝতে গেলে প্রথমে ‘আত্মজীবনী’, এই শব্দটি ভালো করে বুঝতে হবে। ‘আত্মজীবনী’ সেই সাহিত্য, মূলত গদ্যরূপ, যাতে লেখক নিজের জীবনের সমস্ত অথবা বেশ কয়েকটি সত্য ঘটনা, সাহিত্যের দ্বারা, বিভিন্ন পাঠক পাঠিকাকে জানাচ্ছেন। ‘মাটির ময়না’ চলচ্চিত্রে আনুকে দিয়ে পরিচালক তারেক মাসুদ শুধু নিজের শৈশবকাল নয়, বহু দৃশ্যের সাহায্যে তৎকালীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাহিনি বলেছেন। বাংলার মানুষ যখন নিজের মানুষের কথা বলছে, তাকে আত্মজীবনী বলাই চলে। অবশ্য পরিচালক যেমন দৃশ্যের সাহায্যে তৎকালীন বাংলার কথা বলছেন, সেই দৃশ্যের মধ্যে লুকিয়ে থাকা দর্শনের সাহায্যে তিনি বাংলার মানুষের ইতিহাসের ব্যপারে বলছেন। অবশ্য চলচ্চিত্রে তারেক মাসুদ যে ইতিহাসের কথা বলেছেন, তা বুঝতে গেলে প্রথমে আমাদের বাংলার পরিচয় পন্থার ইতিহাস জানতে হবে।
যখন ভারতবর্ষ ভাগ হয় ১৯৪৭ সালে, দুটি রাষ্ট্রের স্থাপনা হয়, ভারত ও পাকিস্তান। পাঞ্জাব ও বাংলার যে জেলাগুলির মুসলমান জনসংখ্যা বেশি ছিল, তা হয়ে পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত এবং বাকি সমগ্র জেলা মিলে একটি হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ কিন্তু সাংবিধানিক ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ, ভারতের জন্ম হয়। অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে একজনের ধার্মিক পরিচয়ের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়েছিল তাঁর রাষ্ট্রীয় পরিচয় নির্ধারিত হয়েছিল। তা বেশি ভালো করে বোঝা গিয়েছিল যখন হাজার হাজার অমুসলমানরা ভারতে পালিয়ে এসেছিল, প্রাণ বাঁচানোর জন্য, এবং একই কারণে বহু মুসলমানেরা ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়েছিল।

১৯৭১ সালে যখন পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশ হয়, তখন মানুষের বাঙালি পরিচয় নির্ধারণ করেছিল তাদের রাষ্ট্রীয় পরিচয়। এই পরিচয় পন্থার সূত্রপাৎ ঘটে ১৯৫২ সালে, বাংলা সাহিত্য চলচ্চিত্রের দ্বারা এক নবজাগরণের মাধ্যমে। অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের বাঙালি পরিচয় তাদের মধ্যে এক স্বাধীন চেতনার জন্ম দেয়।
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ মূলত ভাগ হয় ধর্মের ভিত্তিতে, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলি নিয়ে তৈরি হয় ভারতবর্ষ এবং মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলি নিয়ে তৈরি হয় পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তান। বাংলার হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলি ভারতবর্ষের অংশ হয় এবং মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলি হয় পূর্ব পাকিস্তানের অংশ। অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের সেই সময় পরিচয় ছিল তাদের মুসলিময়ানা। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় নিয়ে যখন আমরা আলোচনা করতে যাই, তখন আমরা বুঝতে পারি যে তখন বাঙালিদের মূল পরিচয় ছিল তাদের বাঙালিয়ানা। এই দুটি দেশভাগের থেকে আমরা বুঝতে পারছি যে পূর্ব বাংলার মানুষের সাধারণত দুটি ধরণের পরিচয় আছে, বাঙালিয়ানা ও মুসলিময়ানা, যা প্রচণ্ড সাবলিল। অবশ্য যদি আমরা প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার ব্যাপারে পড়াশোনা করি, আমরা জানতে পারি যে বাঙালিয়ানা ও ধার্মিক পরিচয়ের পাশাপাশি আরেকটি পরিচয় গড়ে উঠেছিল বাংলার বুকে, যা ছিল জনপ্রিয় ধর্ম। জনপ্রিয় ধর্মের জন্ম হয় যখন গোঁড়া হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের থেকে কয়েকজন মানুষ বেরিয়ে এসে একাধিক উদার সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করেছিলেন। ইসলাম থেকে বেরিয়ে এসে মুলত যে জনপ্রিয় ধর্মের জন্ম হয়, তা ছিল সুফি ইসলাম। এই সুফি ফাকিররা গরিব মানুষদের ঘরে ঘরে গিয়ে ইসলাম কে বেঁচে থাকার এক নতুন উপায় হিসেবে প্রচার করেছিল। ঠিক একইভাবে হিন্দুদের মাঝে থেকে চৈতন্য মহাপ্রভু, হিন্দুদের মাঝে থেকে বেরিয়ে এসে, নবদ্বীপের ভক্তি আন্দোলনের সাহায্যে, জন্ম দিলেন বৈষ্ণব গোষ্ঠীর। আরেকটি জনপ্রিয় ধর্ম, যার জন্ম হয় এই বাংলার বুকে, হল বাউল সম্প্রদায়। এই জনপ্রিয় ধর্ম নিজের ভিত হারাতে শুরু করে যখন কট্টরপন্থিরা নিজের জমি শক্ত করতে শুরু বাংলার বুকে। তবুও এরা যতই চেষ্টা করুক না কেন, এরা বাংলার মানুষের মন থেকে উদার জনপ্রিয় ধর্মকে দূর করতে পারেনা, কারণ তা বাংলার মানুষের আত্মার সঙ্গে নিগূঢ়ভাবে মিশে রয়েছে। এই কথাটির সত্যতা আরও ভালো করে বোঝা যায় এই চলচ্চিত্রের পরবর্তী বহু দৃশ্যে।


এই চলচ্চিত্রে মূলত দু’ধরনের চরিত্র দেখতে পাই, এক যারা ধর্মান্ধ ও আরেকজন যারা ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল। ধর্মান্ধ চরিত্রের পরিচয় হচ্ছে আনুর বাবা, কাজী এবং প্রগতিশীল চরিত্র হচ্ছে আনুর কাকা, মিলন। তারা দুজন একেবারে ভিন্ন ধারার মানুষ। কাজী মিলনের নাম উচ্চারণ পর্যন্ত সহ্য করতে পারেনা, অথচ তারা একই বাড়িতে থাকে। যদি আমরা আনুর মাদ্রাসা দেখি, সেখানেও আমরা দেখতে পাই বড় হুজুরকে, যিনি মারাত্মক কট্টরপন্থী মুসলমান, যিনি ধর্ম রক্ষার্থে জিহাদে বিশ্বাসে। তার অপর প্রান্তে আমরা দেখতে পাই প্রগতিশীল রোকন। রোকন পুরোপুরি ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল হয়ে উঠতে পারেনি, কারণ সে বয়সে সবার চেয়ে ছোট, এবং ধর্মান্ধতার বিরূদ্ধে ওর যে মনের শক্তি, তা ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে এবং এখনো মিলনের পর্যায়ে পৌছায়েনি। অবশ্য রোকনের মধ্যে ধর্মান্ধতার বিরূদ্ধে যে এক বিরক্তি আছে, তা ভালো করে বোঝা যাচ্ছে যখন নিজের কান বন্ধ করে নিচ্ছে, বড় হুজুরের জিহাদী বক্তৃতার সময়। ছবিতে দেখানো হয়েছে যে এক তীব্র আওয়াজের জন্য সে নিজের কান বন্ধ করে নিচ্ছে। ওই আওয়াজ হলো রোকনের মনের ভেতর ধীরে ধীরে গড়তে থাকা ধর্মান্ধতার বিরূদ্ধে রাগ ও বিরক্তি, যা সুদূর ভবিষ্যতে আরও তীব্র ভাবে প্রকাশ পাবে।



অবশ্য এদের মাঝে আরেকটি ধরণের চরিত্রদের আমরা দেখতে পাই, যারা কাজি ও বড় হুজুরের মতো কট্টরপন্থী ও নয়, আবার মিলনের মতো একেবারে কড়া বামপন্থী ও নয়। এমন চরিত্র হলো নৌকাচালক করিম মিঞা এবং মাদ্রাসার ইব্রাহিম হুজুর। করিম মিঞা এবং মাদ্রাসার ইব্রাহিম হুজুর। করিম মিঞার চরিত্রটিকে খুব কম সময়ের জন্য আমরা দেখতে পাচ্ছি কিন্তু সেইটুকু সময়ের মধ্যেই তাঁর চরিত্র এই সমগ্র চলচ্চিত্রে যেন ভারসাম্য তৈরি করে দিয়ে যাচ্ছে, এবং আমাদের মনে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে, সত্যিকারের স্বাধীনতার সাথে কি ধর্মের কোন সম্পর্ক আছে? এই প্রশ্নটি মনে প্রচণ্ড রকমের জেগে ওঠে যখন ইব্রাহিম হুজুর, বড় হুজুরের জিহাদী ভাসনের পর, তার মতাদর্শ প্রকাশ করে যে কেন মাদ্রাসাতে অন্তর্ভূক্ত ছাত্রছাত্রীদের কেন রাজনীতি থেকে দূরে রাখা উচিৎ। ইব্রাহিম হুজুর যখন বাংলাদেশে ইসলামের ছড়ানোর ইতিহাস বলেন, সেখানের থেকেই তাঁর জনপ্রিয় ধর্মের প্রতি আস্থার কথা আমরা বুঝতে পারছি।
পরিচালক তারেক মাসুদ এই জনপ্রিয় ধর্মের প্রচারই করে গেছেন সমগ্র চলচ্চিত্র জুড়ে। এই জনপ্রিয় ধর্মের কারণেই এই চলচ্চিত্রে এক অদ্ভুত মুগ্ধতা, স্নিগ্ধতা ও শান্তির খোঁজ পাওয়া যায়। তিনি এই চলচ্চিত্রের সাহায্যে এটাই দেখাতে চাইছেন যে হয়তো জনপ্রিয় ধর্মের তৎকালীন, সোজাসুজি সেরকম ভক্তবৃন্দ নেই, তবুও এটি বাংলার মানুষের আত্মার সঙ্গে নিগূঢ় ভাবে মিলে আছে। এই চলচ্চিত্রে যে স্নিগ্ধতা, যে ধর্মীয় সহনশীলতা দেখানো হয়েছে, কাজী ও মিলনের একই বাড়িতে থাকা নিয়ে, তা সম্পূর্ণভাবে সম্ভব হয়েছে জনপ্রিয় ধর্মের প্রভাবে। এই জনপ্রিয় ধর্মের প্রভাবেই এখনও বাংলার মানুষ বিশ্বের অন্যান্য হিন্দু ও মুসলমানের তুলনায় অনেক বেশি নরম ও উদার।
তারেক মাসুদের এই চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশের অন্যান্য চলচ্চিত্রের তুলনায় অনেকটা আলাদা। এই চলচ্চিত্রটি মুক্তিযুদ্ধকে এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে তুলে ধরে, যা একেবারে অভূতপূর্ব। এই চলচ্চিত্রটি বাংলার হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতিকে যেভাবে প্রদর্শিত করেছে, তা এটিকে আরো প্রানময় ও একেবারে এক অকল্পনীয় ভীন্ন প্রকারের করে তোলে, এবং এই কারণে সবাই এটি অন্তত পক্ষে একবার দেখা উচিৎ।

India